ঘুড্ডি

-কাজী মোঃ হাসান

কেমন করে যেন এই হযরত আলীর সাথেই রঞ্জুর ভীষণ খাতির হয়ে যায়। হযরত আলীও তাকে খাস মুরিদ বানিয়ে ফেলে। মনের অজান্তেই দু’জনের সম্পর্কটা গিয়ে দাঁড়ায় কাকা-ভাতিজায়।

হেমন্তের শেষ। শীতের পদধ্বনি সবদিকে। প্রায় প্রতিদিনই ভোর রাতের দিকে কায়াশা পড়ছে। মাঝে মাঝে ঘন কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে সব এলাকা। তখন কুয়াশার ফাঁক দিয়ে ঝোঁপের মধ্যে টিপটিপ করে জ্বলতে থাকা জোনাকীর আলো ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না। এমনকি, গাছপালা পর্যন্ত আলাদা ভাবে চিহ্নিত করা যায় না। সকালে ঘুম থেকে উঠলেই দেখা যায়- গাছের পাতা বা ঘাসের ডগায় ঘামের মতো ফোঁটা ফোঁটা শিশির বিন্দু। সূর্যের আলো পড়ে মুক্তোর মতো ঝলমল করছে। হাত রাখলে ভিজিয়ে দেয় শীতের অনুভতি জাগিয়ে। ফোঁটাফোঁটা ঝরে পড়ে মাটিতে।
জোনাকি, সে এক মজার জিনিস। অন্ধকার বাঁশের ঝাড়, ছন ক্ষেত, পুকুর ঘাট- সব জায়গায় জোনাকিরা আপনমনে আলো জ্বালতে জ্বালতে ঘুরে বেড়ায়। সারারাত জোনাকিদের ঘুরাঘুরি। আলোটা এই জ্বলে, এই নিভে। কিন্তু সূর্যের আলো ফুটার আগেই সব উদাও। রঞ্জুরা প্রায়ই জোনাকি পোকা ধরে বন্ধুদের গায়ে ছেড়ে দিয়ে মজা করতো।

শীত এলেই শুরু হয় ঘুড্ডি উড়াবার ধুম। আকাশ জুড়ে তখন লাল, নীল, সাদা, হলুদ, ছোট-বড় হরেক ধরণের ঘুড্ডি। সাধারণ ঘুড্ডির পাশাপশি কেউ কেউ ডাউস ঘুড্ডিও উড়ায়। এর কোনটা সাপ, কোনটা প্রজাপতি, কোনটা বাক্স, কোনটা বা উড়োজাহাজের মতো দেখতে।

ঘুড্ডি বানানো খুব সহজ না। চারকোনা কাগজ কেটে আঠা দিয়ে কঞ্চি লাগানো পর্যন্ত ঠিক আছে, কিন্তু দামতারা (ঘুড়িতে লাগানো সূতা) লাগাতে গেলেই যত গোলমাল। অন্ততঃ রঞ্জুর তাই মনে হয়। বানানো ঘুড্ডিগুলো আকাশে একটু উঠেই ভনভন করে ঘুরতে থাকে চর্কিও মতো। চেষ্টা করেও ঘুরাঘুরি থামাতে পারে না। ঘুরতে ঘুরতেই এক সময় আছড়ে পড়ে মাটির উপর। সুতরাং ঘুড্ডি উড়াবার শখ আপাততঃ এখানেই খতম।

তাই রঞ্জু ঠিক করেছে, এখন থেকে ঘুড্ডি নিজে না বানিয়ে বাজার থেকেই কিনে আনবে। এতে ঝামেলা কম। তবে সে নিশ্চিত- তার বানানো ঘুড্ডিগুলোতে ধামতরার গিট্টুতেই যত গোলমাল।

পরদিনই রউফ কাকাকে নিয়ে বাজারে গেল। আপ কাগজের দুইটা ঘুড্ডি, দুইটা বাঁশের নাটাই কিনে একটা দেয় মঞ্জুকে, অন্যটা নেয় নিজে। কিন্তু নাটাই আর ঘুড্ডি হলেই তো হয় না, ঘুড্ডি উড়াতে গেলে মাঞ্জা দেয়া সূতা লাগে। না হলে, যে কেউ তাদের ঘুড্ডি কেটে নিয়ে যেতে পারে। ঘুড্ডি কাটাকাটি ভীষণ মজার খেলা! এখানে যার সূতা যত ধার, জয় তারই।

মাঞ্জা দিতেও রউফ কাকার সাহায্য নেয় তারা। তাকে ছাড়া এসব কাজ করা অসম্ভব। সবটাতেই ঝক্কি-ঝামেলা! মাঞ্জা দিতে প্রথমেই দরকার হয় ময়দার কাই এবং পাটায় পেষা কাঁচের মিহি গুড়ো।

অনেক অনুরোধের পর বাটি ভরে ময়দার কাই করে দিলেন আম্মু। কাঁচ ভাঙ্গাও পিষে দিলেন তিনি। এবার কাই এবং কাঁচ মিশিয়ে কাপড় দিয়ে আন্তে আস্তে মাঞ্জা দেয় গুটির সূতায়। তারপর বাঁশের কঞ্চিতে পেঁচিয়ে, রৌদ্র্র্র্র্র্রে শুকিয়ে, নাটাইয়ে পেঁচিয়ে তারপর শান্ত হয়। সব গুছাতে গুছাতে একদম সন্ধ্যা। বলতে গেলে পুরু দিনটাই কাবার। শুনতে সহজ হলেও কাজটা তত সহজ নয়। বেশ কঠিন। একটু এদিক সেদিক হলেই হাত কেটে রক্তারক্তি।

পরদিন বিকেলেই উড়াতে যায় লাল ঘুড্ডিটা। সূতা ছাড়তে ছাড়তে নাটাই খালি। হেলে দুলে গুড্ডিটা উড়তে উড়তে সোজা উপরে। শূণ্যে ঘুড্ডিটা যেন ছোট্ট একটা পাখি। যেন একটু একটু করে দোল খাচ্ছে পাখা মেলে।
পরদিনও একই অবস্থা।

তৃতীয় দিন। হঠাৎ পাশের একটা ঘুড্ডি এগিয়ে আসে কাটাকাটি খেলার জন্য। কাটাকাটিতে রঞ্জু খুব ভালো না। কখনো খেলেনি। কখন সূতা ছাড়তে হয়, কখন টানতে হয়- কিছুই জানে না। তাই ভয় ভয় করে- যদি ঘুড়িটা কেটে যায়? তবু কাটাকাটি না খেলে পেছনে সরে আসতে রঞ্জুর আত্মসম্মানে খুব বাধে।
ফলাফল যা-ই ঘটুক কাটাকাটি সে খেলবে। ভয় পেলে চলবে না। বিদ্যাটা শিখতে তো হবে! তা ছাড়া, খেলতে না নামলে সাহস বাড়বে কি করে? ঘুড্ডি কাটাকাটি খেলতে গিয়ে এ সবই ভাবে সে।

শুরু হয় কাটাকাটি। খেলাটা জমে উঠে। সূতা ছাড়তেই ঘুড্ডিটা দুলতে দুলতে নেমে যাচ্ছে নীচের দিকে। আবার একটু টানতেই সা করে সোজা উপরে। উত্তেজনায় রঞ্জুর অবস্থা টানটান। হঠাৎ দেখে তার ঘুড্ডিটা কেটে বাতাসে ভাসতে ভাসতে উড়ে যাচ্ছে গায়ের মাথা ডিঙ্গীয়ে।
ধরার জন্য পিছুপিছু দৌড় দেয় রঞ্জু। অনেক উচুতে থাকায় অনেক দূর গিয়েও লাভ হলো না। মাটিতে নামলোই না ঘুড্ডিটা। সম্ভবতঃ দুই তিন গ্রামের পর মাটিতে গিয়ে পড়েবে ওটা।

তার একদিন পর অন্য ঘুড্ডিটাও শেষ। তীব্র বাতাসে ঘুরতে ঘুরতে গোত্তা মেরে মাটিতে আছড় খেয়েই ফটাস। ছিড়ে টুকরো টুকরো।
রঞ্জু মনে মনে ঠিক করে-
: না, আপ কাগজের ঘুড্ডি আর না। এবার ডাউস ঘুড্ডি বানাবে। কিন্তু কি ভাবে? সে তো সাধারণ ঘুড্ডিও বানাতে জানে না।
সিদ্ধান্ত নেয়ার পর দিন থেকেই একটা ডাউস ঘুড্ডি বানিয়ে দেয়ার জন্য একে ওকে ধরাধরির করে। কারো কাছে সাহায্য না পেয়ে বাধ্য হয়েই একদিন স্মরণাপন্ন হয় হযরত আলী কাকার। ভীষণ ব্যস্ত মানুষ। হাতে একদম সময় নেই। তা সত্ত্বেও রঞ্জু হাল ছাড়ে না। নাছোড়বান্দার মতো লেগে থাকে।

এক সপ্তাহ পর সুমতি হয় হযরত কাকার। একটা প্রজাপতি ঘুড্ডি বানিয়ে দিলেন তিনি। ঘুড্ডিটা বিরাট। লেজটাই প্রায় দশ হাত। মুখে ধনুকের মতো বাঁকা বড় বড় তিনটা ভেমা (ঘুড়ির মুখে লাগানো এক ধরণের বাঁশের তীর, যা থেকে ভোঁ ভোঁ আওয়াজ হয়)। ইচ্ছে করলে এগুলো খুলে রাখা যায়। ভেমা থাকলে আকাশে উড়ার পরপরই শুরু হয় ভ্রমরার মতো ভোঁ ভোঁ আওয়াজ। বাতাস যত বাড়ে আওয়াজ তত ছড়ায়। ছড়াতে ছড়াতে চলে যায় দূর থেকে দূরে- বহু দূরে। রঞ্জুর মনে হয়- আওয়াজটা উড়তে উড়তে হিমালয় পর্ব্বতে ধাক্কা না খেয়ে যায় না!

ঘুড্ডিটা রঞ্জুর চাইতেও বড়। তাই দূরে নিয়ে যাওয়াটা খুব কষ্টের। বিশেষ করে লেজটা হয়েছে যত ঝামেলার। ওটা পেঁঁচিয়ে মাথায় নিয়ে, নয়তো কোন রকমে হেঁচড়াতে হেঁচরাতে নিয়ে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই।

তবে একবার উড়াতে পারলেই ব্যাস, আর কোন ঝামেলা নেই। বাতাসে ভর করে ওটা সোজা উঠতে থাকে আকাশের দিকে।
প্রথম দিন ঘুড্ডিটা উড়ানোর সময় রশি ধরে ছিলেন হযরত আলী কাকা। কাঁপতে কাঁপতে ঘুড্ডিটা উপরে উঠে গেলে রশিটা হাতে নেয় রঞ্জু। আস্তে আস্তে রশি ছাড়ে। ঘুড্ডিটা আরো উপরে উঠে। উড়তে উড়তে একদম আকাশের কাছাকাছি চলে যায়। রঞ্জু মনে মনে ভাবে, ঘুড্ডিটা আকাশ পেরিয়ে ওপারে যেতে পারলে কেমন হয়! একদম উপরে- চোখের সীমানা ছাড়িয়ে সপ্ত আসমানের কাছাকাছি। আচ্ছা, সপ্ত আসমানে কি আছে? খবরটা জানতে পারলে ভীষণ মজা হতো! রঞ্জু শুনেছে, আজকাল রকেটে চড়ে মানুষ চাঁদে যাওয়ার চেষ্টা করছে। হয়তঃ একদিন যাবেও। বসবাস করবে ঘরবাড়ি তুলে।

বাতাসের ঝাপটায় রশিতে ভীষণ টান পড়ে। মনে হয়, ঘুড্ডিটা বুঝি এক্ষনি তাকে উড়িয়েই নিয়ে যাবে! তবে শুরু থেকেই নাটাইটা গাছের সাথে বাঁধা থাকায় সে ভয় থেকে রক্ষা।

(চলবে……………)
(“রঞ্জুর ছেলেবেলা”- থেকে)

Related posts

Leave a Comment